দেশের সব কাজেই এখন ঘুষ প্রয়োজন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রয়োজন ঘুষ। হাসপাতালে শিশু জন্মের সময় প্রসূতির ভর্তি ও যত্ন-আত্তি থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তির কবরের জায়গা কিনতেও প্রয়োজন ঘুষের। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, হাসপাতালে চিকিৎসা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ওষুধ তৈরির অনুমোদন, ইটভাটার লাইসেন্স, বাড়ির পরিকল্পনা পাস, পিয়ন-ড্রাইভারের চাকরি এমনকি মসজিদ-মন্দিরের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ নিতেও প্রয়োজন ঘুষের।
ঘুষ ছাড়া কোনো সরকারি দফতরেই যে সাধারণের সেবা নেই_ সেটা অবধারিতভাবে মেনে নিয়েছে সবাই। কিন্তু এখন বেসরকারি ব্যাংক-বীমার চাকরি ও সেবায়ও প্রয়োজন হচ্ছে ঘুষের। বেসরকারি দাতা সংস্থার সাহায্য নিতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে একটি পারসেনটিজ দিয়ে খুশি করতে হয়। সবারই চাই কিছু না কিছু 'উপরি'।
নানা প্রতিশব্দে সমাজে ঘুষের লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে 'চা-পানের খরচ', 'সেলামি', 'খুশি করা', 'খরচাপাতি', 'ঈদখরচা', 'উপরি', 'বকশিশ', 'উপঢৌকন', 'উৎকোচ', 'মালপানি', 'বোনাস', 'কমিশন' বা 'পারসেনটিজ' ইত্যাদি। প্রতিটি কাজের জন্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে ঘুষের হার। বলা হচ্ছে- বাজারদর বেড়েছে তাই বেড়েছে 'খরচা'। অনুসন্ধানে জানা যায়, সব সময়ই ঘুষ লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে পুলিশ বিভাগ, বিআরটিএ, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, সারা দেশের এলজিইডিসহ সব প্রকৌশল অফিস, কাস্টমস ও পণ্য পরিবহনসংক্রান্ত বন্দর, শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো, ওয়াসা, ডেসা, বিদ্যুৎ অফিস, তিতাস এবং রাজউক।
তবে এখন আর কেউ ঘুষ গ্রহণে পিছিয়ে থাকতে চায় না। স্কুলে ভর্তিতে প্রয়োজন ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতিতে ৭০ হাজার থেকে তিন লাখ, সরকারি চাকরি পেতে ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ, সরকারি হাসপাতালে ভর্তিতে ৫০০ থেকে দুই হাজার, পাসপোর্টে তিন হাজার, ড্রাইভিং লাইসেন্সে ছয় হাজার, আমদানি পণ্য খালাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার, ওষুধের নাম অনুমতিতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, হাউস লোন এক থেকে পাঁচ লাখ, ব্যাংক-ঋণের সুদমুক্তি এক লাখ থেকে ৫০ লাখ এবং এক লাখ টাকার জমি রেজিস্ট্রিতে ২০ হাজার টাকা ঘুষ প্রয়োজন।

বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্সে পাঁচটি পরীক্ষায় ৫০০ করে আড়াই হাজারসহ পাঁচ-ছয় হাজার, ফিটনেস পরীক্ষায় গাড়ি থাকলে ১০০, গাড়ি না থাকলে এক হাজার, রেজিস্ট্রেশনে আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার, রুটপারমিটে এক থেকে তিন হাজার, মালিকানা পরিবর্তনে দুই থেকে চার হাজার টাকা ঘুষ প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনে ৫০০ থেকে এক হাজার, এমপিওভুক্তি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, শিক্ষকদের বেতন মঞ্জুরকরণ ১০ থেকে ৩০ হাজার, সরকারি স্কুলে বদলিসংক্রান্ত ১৮ থেকে ২০ হাজার, পেনশন কাগজপত্র প্রসেসিং ১০ থেকে ১৫ হাজার এবং পরিদর্শক স্কুলে গেলে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। উচ্চবিদ্যালয়ের বিএড অন্তর্ভুক্তকরণে এক থেকে দুই হাজার, এমপিও অন্তর্ভুক্তকরণে ৪০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার, শিক্ষকদের বেতন মঞ্জুরকরণ ৩০ থেকে ৫০ হাজার, সরকারি স্কুলে বদলি ২০ হাজার থেকে এক লাখ, পেনশন-সংক্রান্ত কাজ ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষের রেট চলছে শিক্ষাভবনে। কলেজ এমপিওভুক্তিকরণে এক থেকে দুই লাখ, শিক্ষক বেতন পাস করতে ২০ থেকে ৫০ হাজার এবং পরিদর্শক কলেজে গেলে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিধিমাফিক ফি যাই হোক না কেন এক থেকে ছয় তলা পর্যন্ত বাড়ির প্ল্যান পাস করতে খরচ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা। ১৫-২০ হাজার টাকা অগ্রিম, বাকিটা কাজের পর। বাড়ির স্থান ও তলাভেদে রেটের পরিবর্তন হয়। কখনো কখনো ১০ লাখেও পেঁৗছে। বিরোধযুক্ত কোনো জমির ওপর রাজউক থেকে নিষেধাজ্ঞার নোটিস আনতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ করতে হয়। অতিরিক্ত টাকা গুনলে রাজউক তার নিজের জমি অন্যের নামে বন্দোবস্ত করে দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সারা দেশের অফিসে প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ অনুযায়ী ১০, ২০ ও ৩০ শতাংশ কমিশনের সিস্টেম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্রিজ বা রাস্তা না করেই কাজ হয়েছে দেখিয়ে বরাদ্দ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে কমিশনের পরিমাণও বেড়ে যায়।
পুলিশের থানাগুলোয় গেলে টাকা নিয়ে যেতে হবে_ এটাই নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছে সবাই। এক প্যাকেট 'গোল্ডলিফ' সিগারেট থেকে কোটি টাকার ব্যাগ_ কোনোটিতেই না নেই পুলিশের। রাস্তায় লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল চালালে ঘুষ প্রয়োজন ৫০০ টাকা। বার থেকে মদপান করা যুবকের পকেটে কয়েক শ টাকা থাকলেই সে ছাড়া পায়। থানায় আটক ব্যক্তিতে দেখতে গেলে প্রয়োজন এক প্যাকেট গোল্ডলিফ। বৈধ কাজেও ঘুষ দিতে হয় পুলিশকে। অবশ্য সেটা ঘুষ নয় 'খরচাপাতি'। যেমন বাসাবাড়িতে চুরি-ডাকাতি হলে পুলিশ এলে তাকে খরচ দিতে হয় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। পুলিশের নিজেকেও বিভিন্ন সময়ে ঘুষ দিতে হয়। সাব ইন্সপেক্টর পাঁচ-সাত লাখ, সার্জেন্ট ছয় লাখ, কনস্টেবল পদে চাকরি পেতে তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। দিতে হয় বদলি হতে কিংবা বদলি ঠেকাতেও। ঢাকার উচ্চ আয়ের থানাগুলোয় এসআই পদে বদলি হতে ১০ থেকে ১৫ লাখ, এএসআই পাঁচ লাখ এবং কনস্টেবল পদে এক লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হয়। আর ওসির পদের জন্য হিসাবই শুরু হয় ৫০ লাখ থেকে।
সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংক থেকেই বড় বড় ঋণ কমিশনের ভিত্তিতে দেওয়া হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে এক থেকে ৩০ কোটি টাকায় যে কোনো লোন পাস করাতে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ কমিশন গুনতে হয়। শিল্পঋণের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কমিশনও দিতে হয়। আবার ঋণের সুদ মওকুফে চলে ঘুষের টাকার অন্য খেলা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে আয়কর ফাইল খুলতে হলে কর পরিদর্শককে এক হাজার, সহকারী কর কমিশনার দু-তিন হাজার ও পিয়নকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে ঋণ নিতে হলে প্যাকেজ প্রোগ্রামে যেতে হয়। সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার ক্ষেত্রে কাজ শুরুর আগে অগ্রিম হিসেবে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়। ঋণ পাওয়ার পর আরও ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়। ঋণের পরিমাণ বেশি হলে টাকাও বেড়ে যায়।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, 'দেশে প্রায় সব সেক্টরেই ঘুষের প্রচলন রয়েছে। তবে পুলিশ শীর্ষে। এ সেক্টরে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। এর পরই শিক্ষার অবস্থান। এখানেও ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না।' তিনি বলেন, 'ঘুষ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে ফলাফল আশানুরূপ নয়। জাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকতে হলে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।'
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, 'ঘুষ দিতে আমরা এখন অভ্যস্ত। বার্থ সার্টিফিকেট কিংবা ডেথ সার্টিফিকেট, স্কুলে ভর্তি কিংবা চাকরি_ কোনো কিছুই এখন আর ঘুষ ছাড়া হয় না। ঘুষ দেওয়া-নেওয়াটা আমাদের সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।' তিনি বলেন, 'সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার আগে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে নিজেরাই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে যায়।'