সব থানার বিভিন্ন কক্ষে লেখা আছে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ কিংবা ধূমপানমুক্ত এলাকা’। কিন্তু দেখা যায় লেখা নেমপ্লেটের নিচে বসেই দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট খাচ্ছেন। এই চিত্র দেখা গেল রাজধানীর নিউমার্কেট থানায়। ‘আর পুলিশ ঘুষ খায়’- কথাটিই নাকি উদ্ভট- এমন বিস্ময়কর মন্তব্য করলেন ওই থানারই এক কর্মকর্তা। রাত তখন প্রায় ১২টা। শীতের রাত। নগরবাসীর বেশির ভাগই ঘুমে। নীরব রাস্তা । দুই একটা রিকশা চলছে। অবশ্য নীলক্ষেত এলাকায় রাস্তার ধারে ডিমের দোকানগুলো তখনো সরব ।
নীলক্ষেত পেরিয়ে মোটরসাইকেল বামে মোড় নিল। সামনে নিউমার্কেট থানা। একটা বাল্ব বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আধো আলো আধো অন্ধকার পরিবেশ।
থানার ঢুকলাম। ভেতরেও একই পরিবেশ। একটা তালাবদ্ধ দরজায় চোখ পড়ল। দেয়ালের নেমপ্লেটে লেখা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি এ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ওসি সাহেব নেই’? খুব গভীরভাবে আমাকে দেখে বললেন, “না। ডিউটি অফিসার আছেন।” পাশের একটি রুম দেখিয়ে দিলেন।
দু’জন বসে আছেন। একজনের সামনে কয়েক ধরনের ওয়ারলেস। অন্যজন ডিউটি অফিসার শফিউর হক।
রুমটি স্যাঁতসেতে। দেয়ালে অনেক ছোট বড় পোস্টার। সবগুলোই সচেতনতামূলক। পরিচয় দিতেই শফি সাহেব হেসে বললেন, “আজ কোনো ঝামেলা নাই। থানা খালি।”
আলাপ শুরু হলো। শফি সাহেব শুরুতেই উপদেশ দিলেন “পুলিশকে শত্রু ভাববেন না। পুলিশের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হয়। তাহলে তথ্য পাওয়া সহজ হয়। আগে অনেক সাংবাদিক পুলিশকে বাঁকা নজরে দেখত। এখন এ প্রবণতা কমেছে।”
জানতে চাইলাম পুলিশ কেন ঘুষ খায়। শফি সাহেব হাসলেন। চোখে মুখে একটা কষ্ট দেখলাম। তিনি বললেন, “পুলিশ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করে। থানায় জিডি করতে টাকা লাগে না। নানাভাবে তারা মানুষের সেবা করেন। তাদের ভালো বিষয়গুলো কেউ তুলে ধরতে চায় না।”
একটু থামলেন। এরপর বললেন, ‘আমরা ঘুষ খাই - এটি উদ্ভট ও বানোয়াট। এটি প্রচার করে পুলিশকে মানসিক চাপে রাখার চেষ্টা করা হয়।”
বললাম “থানায় অনেকে জিডি করেন। জিডি করে কি আদৌ লাভ হয়?”
এমন সময় বলতে বলতে রুমে ঢোকেন এস আই খায়রুল বাশার। তিনি থানায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বললেন, “জিডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বলতে পারেন ইতিহাস। খুব স্পর্শকাতর বিষয়। ৭৫ বছর পর্যন্ত প্রতি থানায় জিডির বই সংরক্ষিত থাকে। এলাকার মানুষের পেটে ব্যথা, পশুর রোগ আর আবহাওয়ার বিষয়ও পুলিশ চাইলে জিডি করে রাখতে পারে।”
এরপর তিনি একটা দামি ব্রান্ডের প্যাকেট হতে একটা সিগারেট ধরালেন। যদিও তার মাথার ওপর নেমপ্লেটে লেখা ‘এখানে ধূমপান করবেন না’।
খায়রুল বাশারের সঙ্গে আসা কনস্টেবল আফজাল বললেন, “এ কারণে অনেক সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা খুব সচেতনভাবে জিডি করেন।”
বাশার সাহেব কথা বলতে শুরু করলেন। “জনবল ও তথ্য প্রযুক্তির সাপোর্ট দিলে পুলিশ সমাজটাকে বদলে দিতে পারবে। তাদের কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। পুলিশকে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সেবা শিক্ষা দেয়া হয়। তবে সেই সেবা সম্পর্কে অপরাধীরাও এক্সপার্ট হয়ে ওঠার পর। অথচ উন্নত দেশে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সম্পর্কে সবার আগে পুলিশকেই জানানো হয়।”
শফিউর হক বলেন, “পুলিশের অনেক কষ্ট। সেসব কথা স্বীকার করলেও সমস্যা। কিন্তু স্বীকার না করেও পারি না। তবে স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে মন্তব্য করি না। কষ্ট আরো হয় যখন দেখি মানুষ পুলিশকে মন্দ কথা বলে। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্ব পালন করার সময় এক ছাত্র আমাকে ‘বুড়া বেটা’ বলল।”
কথা শেষ না হতেই কনস্টেবল আফজাল বলেন, “ক্যান স্যার। তার বাড়িতে কি বুড়া বাপ নাই। তার দাদা কি মারা যায় নাই।” বসের প্রতি এটি তার ভালোবাসা নাকি আনুগত্য এটা বোঝা গেল না।
তাকে থামিয়ে দিয়ে শফিউর সাহেব বললেন, “আমরা চাইলে তো সে ছেলেটিকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু দিলেই সমালোচনার বন্যা বইতো। আমাদের নিজেদের মধ্যেই অনেকেই বলতেন ‘ছাত্রদের শাস্তি দেন। কেমন মানুষ আপনে। ম্যানেজ করে চলতে পারলেন না।’
বিদায় নিলাম। রাত তখন দুইটা।
courtesy: http://www.barta24.net/index.php?view=details&spc_news=yes&data=Bank&news_type_id=1&menu_id=64&spc_id=38&news_id=28654